রাজনীতি কাকে বলে? | রাজনীতি মানে কি?

রাজনীতি কাকে বলে: আজকে আমরা জানবো রাজনীতি কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন। আশা করি আপনারা এই প্রশ্নের উত্তর ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন।

রাজনীতি কাকে বলে,রাজনীতি মানে কি,রাজনীতি কি pdf
রাজনীতি কাকে বলে

রাজনীতি কাকে বলে?

রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। এটি আপোষের ও অহিংস রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে ইতিবাচক অর্থে, অথবা সরকার বিষয়ক বিজ্ঞান বা কলা হিসেবে বিশদভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু পাশাপাশি এটি প্রায়শই একটি নেতিবাচক অর্থও বহন করে।

রাজনীতি (Politics) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোন গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা দিয়ে নাগরিক সরকারের রাজনীতিকেই বোঝানো হয়, তবে অন্যান্য অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেখানে রাজনীতি চর্চা করা হয়। রাজনীতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভিত্তিতে গঠিত সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গঠিত একটি ব্যবস্থা।

ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে এবং নানা কারণে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তাই রাজনীতি দেখা দেয় এবং রাজনীতি হয় উত্তেজক। কেমনভাবে জীবনযাপন করা উচিত, কার কি পাওয়া উচিত; সমাজ সহযোগিতাভিত্তিক, নাকি সংঘাতভিত্তিক হওয়া উচিত; ক্ষমতা ও অন্যান্য সম্পদ-সামগ্রী বণ্টিত হওয়া উচিত— এ রকম অসংখ্য বিষয়ে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।

এই সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান কিভাবে হওয়া উচিত; সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত কিভাবে গৃহীত হওয়া উচিত; কার বা কাদের সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পাওয়া উচিত; প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাধান্য কতটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত— এ ধরনের বহুবিধ বিষয়ে মতামতের অনৈক্যের অভাব নেই। এই প্রক্রিয়ার সুবাদে মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নতর করার উদ্দেশ্যে উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করে। এবং এইভাবে সুন্দর সমাজ সৃষ্টির পথ প্রশস্থ হয়। এই কারণে গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল রাজনীতিকে ‘শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান’ (master science) হিসাবে অভিহিত করেছেন।

Also Read: অর্থনীতি কাকে বলে

চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতি হল এক ধরনের সামাজিক প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ড। রাজনীতি সবসময়ই সকলের মধ্যে সংলাপ; কখনই স্বগতভাষণ নয়। ব্যক্তি মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে রাজনীতির সামিল হতে পারে না। রাজনীতির মূলে মতপার্থক্য বর্তমান। সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া (interaction) কিভাবে রাজনীতিক হয়ে দাঁড়ায় এবং রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মকে কিভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাবে সে বিষয়েও মানুষের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়।

রাজনীতি হল এক ধরনের কর্মতৎপরতা। এই কর্মতৎপরতা সকল সমাজেই সর্বজনীন। অতীত, বর্তমান, এমনকি ভবিষ্যৎ – সর্বকালে ও সর্বপর্যায়ে রাজনীতিক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতিক কাজকর্ম কেবলমাত্র রাষ্ট্র, রাজনীতিক দল, গোষ্ঠী, শ্রমিকসংঘ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পরিবার, স্কুল-কলেজ, সংঘ-সংগঠন, পৌর প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন, বহুজাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই রাজনীতিক কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়। সরকারী ক্ষেত্রসমূহের মত, বেসরকারী ক্ষেত্রসমূহেও রাজনীতিক কর্মতৎপরতার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, রাজনীতিক ক্ষেত্রের কুশীলবরা হলেন রাজনীতিবিদ, রাজনীতিক দল, সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, নির্বাচন প্রভৃতি। তা ছাড়া আছে চাপসৃষ্টিকারী বা স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ, আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, গণ-মাধ্যমসমূহ প্রভৃতি। এগুলি রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মের পটভূমি প্রস্তুত করে।

জনজীবনে রাজনীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতিক মতাদর্শ ও সিদ্ধান্তসমূহের দ্বারা। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদসমূহের সুবাদে এ বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়।

সামাজিক জীবনধারায় রাজনীতি অপরিহার্য। রাজনীতির ফলাফলকে সমাজজীবনে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত বিষয়াদির দ্বারা রাজনীতির এলাকা নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বভাবতই রাজনীতির অর্থ, প্রকৃতি ও পরিধি ম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক।

রাজনীতির প্রাচীন ধারণা: রাজনীতি শব্দটি বহু ও বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ রাজনীতির অর্থ সম্পর্কে ব্যাপক মতানৈক্য বর্তমান। রাজনীতির ধারণা এবং আলোচনাক্ষেত্র সম্পর্কে লেখালেখিরও অন্ত নেই। রাজনীতিবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকালের একজন সুপরিচিত লেখক অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “… politics may be treated as an essentially contested” concept, in the sense that the term has a number of acceptable or legitimate meanings. On the other hand, these different views may simply consists of contrasting conceptions of the same, if necessarily vague, concept.” এ প্রসঙ্গে হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন (Rod Hague, Martin Harrap and Shaun Brestin) তাঁদের Comparative Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The study of politics is always an uncertain subject in which the perspective of the observer makes a difference to the results obtained. Enlightenment comes not from ignoring differences in political approach but from confronting them and making them explicit.”

সুতরাং রাজনীতি বলতে কি বোঝায় তা সহজে ও সংক্ষেপে বলা সম্ভব নয়। প্রাচীনকালে গ্রীক দর্শনে রাজনীতি বলতে যা বোঝান হত, আধুনিককালে ঠিক সেই অর্থে ‘রাজনীতি’ কথাটি ব্যবহার করা হয় না। সাবেকী গ্ৰীক্ চিন্তা অনুসারে ‘রাজনীতি’ বা ‘Politics’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রীক শব্দ থেকে। এই দুটি গ্রীক শব্দ হল: ‘পোলিশ’ (Polis) এবং ‘পলিটেজ’ (polites)।

প্রাচীনকালের গ্রীক সমাজব্যবস্থা কতকগুলি স্বাধীন নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এ রকম প্রতিটি নগররাষ্ট্রের নিজস্ব সরকার ছিল। সমকালীন গ্রীক নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বৃহত্তম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এথেন্স। এই এথেন্সকে গণতান্ত্রিক সরকারের উৎপত্তিস্থল বলে বিবেচনা করা হয়। যাইহোক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিবেচনা করলে, ‘পোলিশ’ (Polis) সম্পর্কিত বিষয়াদিই ‘পলিটিক্স’ (Politics) বা রাজনীতি হিসাবে পরিগণিত হয়। অ্যান্ড্রু হেউডের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতির এই সংজ্ঞার আধুনিক ভাষ্য হল, ‘রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদিই রাজনীতি। হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The modern form of this definition is therefore what concerns the state. This view of politics is clearly evident in the everyday use of the term people are said to be ‘in politics’ when they hold public office, or to be ‘entering politics’ when they seek to do so. It is also a definition that academic political science has helped to perpetuate.”

রাষ্ট্র সম্পর্কিত উপরিউক্ত ধারণা ঐতিহ্যবাদী। এই সংজ্ঞার মাধ্যমে রাজনীতির এক সীমাবদ্ধ ধারণা অভিব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ মন্ত্রীদের দপ্তরসমূহ, আইনসভার কক্ষসমূহ, সরকারী দপ্তরসমূহ প্রভৃতি হল রাজনীতির এলাকার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কেবলমাত্র মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষমতার দালালরাই রাজনীতি করে। অধিকাংশ মানুষ, প্রতিষ্ঠানসমূহ ও সামাজিক কার্যকলাপ রাজনীতির এলাকার বাইরে। দেশশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয় এমন সবকিছুই অ-রাজনীতিক। হেউড মন্তব্য করেছেন: “By the same token, to potray politics an essentially state-bound activity is to ignore the increasingly important international or global influences upon modern life.’

রাজনীতির এই ধারণা গ্রীক নগর-রাষ্ট্র ও সমকালীন নাগরিক জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সময় নৈতিক চিন্তা বা বিশেষ আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় বা নাগরিক জীবনের সমস্যাদি বিচার-বিবেচনার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিককালে ব্যবহারিক অর্থেই ‘রাজনীতি’ কথাটির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীনকালের রাজনীতিক দার্শনিকরা প্রধানত অবরোহমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পক্ষপাতী ছিলেন।

সমকালীন চিন্তাবিদরা মানুষের রাজনীতিক ও সামাজিক প্রবণত। ও আচরণ সম্পর্কে কতকগুলি পূর্বানুমান নির্দিষ্ট করে নিতেন। অতঃপর এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে তাঁরা রাষ্ট্র এবং মানুষের রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তত্ত্বগত ধারণা বা মতবাদ গড়ে তুলতেন।

এই সমস্ত রাজনীতিক মতবাদের পিছনে অভিজ্ঞতাবাদী অনুসন্ধান বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল না বললেই চলে। রাজনীতির এই আলোচনা ছিল মূলত দর্শনমূলক (speculative)। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিশ্বাস (D. K. Biswas) তাঁর Political Sociology শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The ancient Greeks explained the political rule as government by pure persuasion and they described the art of governing by use of force as a pre-political phenomenon.”

সাধারণ অর্থে রাজনীতি: সাধারণভাবে রাজনীতি কথাটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সাধারণত নির্বাচন, আইনসভা, মন্ত্রিসভা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতি কথাটি প্রয়োগ করা হয়। রাজনীতিক দলীয় মতবাদ, রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই, দলীয় নেতাদের কৌশল প্রভৃতির সঙ্গে রাজনীতিকে একিভূত করে ভাবা হয়। অর্থাৎ নিছক দলীয় রাজনীতির সঙ্গে রাজনীতির ধারণাকে গুলিয়ে ফেলা হয়।

এ প্রসঙ্গে জয়ারাম (N. Joyaram) তাঁর Introductory Sociology শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “In everyday popular usage, politics is seen as being about ‘Parliament’, ‘the government’, ‘the parties’, ‘elections’, ‘voting’, and endless debates and arguments which produce more yawns than excitements.” রাজনীতির অর্থ সম্পর্কিত এই সংকীর্ণ সাধারণ ধারণা বিভ্রান্তিমূলক। সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের স্থিতিশীল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ‘রাজনীতি’ প্রসঙ্গে এই ধারণার প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতি সম্পর্কিত এই ধারণার সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে জয়ারাম আরও বলেছেন: “But purely on a factual level, it is ethnocentric and lacking in historical perspective….” কেবলমাত্র রাজনীতিবিদদের আচরণ বা কার্যকলাপই হল রাজনীতি, এই ধারণা সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট এবং বিভ্রান্তিমূলক।

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি: রাজনীতির সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উপরিউক্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করা হয়। সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় অধিকতর ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির ধারণাকে ব্যাখ্যা করা হয়। রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতিক আচরণ আলোচনার কথা বলা হয়। সমগ্র সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হিসাবেই রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব রাজনীতিকে পর্যালোচনা করার পক্ষপাতী। রাজনীতিক আচরণ হল সামাজিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।

বৃহত্তর সামাজিক জীবন থেকে রাজনীতিক জীবন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন নয়। বৃহত্তর সামাজিক সমস্যাই প্রকাশিত হয়। রাজনীতিক সমস্যার মাধ্যমে। বস্তুত বৃহত্তর সামাজিক পরিস্থিতির পটভূমিতেই আধুনিক রাজনীতির অভিব্যক্তি ঘটে। গ্রাহাম ওয়ালাস, আর্থার বেণ্টলে, চার্লস মেরিয়াম প্রমুখ রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা বৃহত্তর সামাজিক পটভূমি ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির ধারণাকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।

ব্যাপক অর্থে রাজনীতি: ব্যাপক অর্থে রাজনীতি বলতে বিশেষ কিছু ক্রিয়াকলাপকে বোঝায়। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মানুষ কিছু সাধারণ নিয়মকানুন তৈরী করে, সংরক্ষণ করে ও সংশোধন করে। এই সমস্ত বিধিব্যবস্থার আওতায় মানুষ বসবাস করে। রাজনীতি বিজ্ঞানের আধুনিককালের একজন বিশিষ্ট লেখক অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Politics, in its broadest sense, is the activity through which poeple make, preserve and amend the general rules under which they live.” এ দিক থেকে বিচার করলে রাজনীতি অনিবার্যভাবে দ্বন্দ্ব ও সহযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

অর্থাৎ মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ বিধি-বিধান সম্পর্কিত কার্যকলাপ রাজনীতি হিসাবে পরিগণিত হলে তার দুটি দিক আছে। এই দুটি দিক হল সংঘাত (conflict) ও সহযোগিতা (cooperation)। মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থার ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী মতামত, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী চাহিদা ও পরস্পর বিরোধী স্বার্থ থাকে। তারফলে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। আবার অপরদিকে মানুষ স্বীকার করে যে সংশ্লিষ্ট সাধারণ বিধি-ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য এবং তাদের প্রয়োগ ও কার্যকারিতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য সহযোগিতার ভিত্তিতে সুসংহতভাবে উদ্যোগী হওয়া আবশ্যক।

অনেকে এই রাজনীতিক ক্ষমতাকে সুসংহত ক্রিয়াকলাপ হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। এই কারণে অনেকের অভিমত অনুসারে রাজনীতির মূলে দ্বন্দ্ব মীমাংসার প্রক্রিয়া (process of conflict resolution) বর্তমান থাকে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পর বিরোধী মতামত ও প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধিত হয় বা সামঞ্জস্য সাধনের উদ্যোগ আয়োজন গৃহীত হয়। তবে সকল দ্বন্দ্বের মীমাংসা বা সংঘাতের সমাধান বা সামঞ্জস্য সাধন হয় না। বা সম্ভব হয় না। এতদ্‌সত্ত্বেও বৈচিত্র্য এবং অভাব-অভিযোগের অনস্বীকার্য অস্তিত্বের কারণে মানবসমাজে রাজনীতিক প্রক্রিয়া অনিবার্য।

সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া: রাজনীতিকে সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাজনীতি হল একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গোষ্ঠীসমূহ সমষ্টিগত সিদ্ধান্তে উপনীত। এই রাজনীতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে গোষ্ঠির আকার-আয়তন ছোট বা বড় হতে পারে। ছোট বলতে একটি পরিবারের মত ছোট হতে পারে; আবার বড় বলতে বিশ্ব জনসম্প্রদায়ের মত বড় হতে পারে। তেমনি আবার বিভিন্ন উপায়ে রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিবিধ উপায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আলাপ-আলোচনা, বিদ্যমান প্রথা, দর কষাকষি, হিংসা বা বলপ্রয়োগ, ভোটাভুটি প্রভৃতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপায় বা গোষ্ঠীর আকার যাইহোক না কেন, মূল কথা হল সমষ্টিগত প্রকৃতিই সিদ্ধান্তকে রাজনীতিক করে। গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সকলেই রাজনীতিক সিদ্ধান্ত স্পর্শ করে।

শান্তিপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে গোষ্ঠীসমূহ কী অবস্থায় এবং কীভাবে তাদের লক্ষ পূরণে সমর্থ হয়, তা রাজনীতির আলোচনা থেকেই অনুধাবন করা যায়। এদিক থেকে বিচার করলে রাজনীতি হল একটি গঠনমূলক ও ব্যবহারিক বিষয়। সুতরাং রাজনীতি মানেই বিবাদ-বিসংবাদ নয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াও রাজনীতি হয়। তবে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, কোন একটি গোষ্ঠীর সদস্যরা কী করবে না-করবে সে প্রসঙ্গে কদাচিৎ সহসা সহমতাবলম্বী হয়। অন্তত প্রাথমিকভাবে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায় না। লক্ষ্য সম্পর্কে সহমত পোষণ করলেও, লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায়-পদ্ধতি সম্পর্কে মতানৈক্য প্রকট হয়ে পড়ে। এবং এই মতানৈক্য থেকেই অনেকাংশে রাজনীতির আবির্ভাব ঘটতে দেখা যায়।

Also Read: অবস্থান্তর মৌল কাকে বলে

রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল একটি গোষ্ঠীর লক্ষ্য স্থাপন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গোষ্ঠীর ভিতরে সম্পদসমূহের বণ্টন কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। সম্পদের ভাণ্ডার অফুরন্ত বা অসীম নয়। সম্পদ-সামগ্রীর সীমাবদ্ধতা আছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতার অর্থ হল কিছু চাহিদা বা উদ্দেশ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তেমনি আবার একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে কোন অংশ অন্যান্যদের থেকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। সুতরাং আংশিকভাবে হলেও অভাব-অনটন থেকে ঐকমত্যের অভাব দেখা দেয়।

আবার নিতান্তই স্বাভাবিক মতপার্থক্যের কারণেও দ্বন্দ্ব বা বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হতে পারে। যদি কোন একটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে একটি গোষ্ঠীর সকল সদস্য সমষ্টিগতভাবে সংযুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে একটির অধিক সিদ্ধান্ত হওয়া অনুচিত।

বরং আরও স্পষ্ট করে বলা আবশ্যক যে, এ রকম ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত অতি অবশ্যই একটি হবে। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন (Rod Hague, Martin Harrop and Shaun Breslin) তাঁদের Comparative Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন যে, কোন যাযাবর গোষ্ঠী তাদের তৎকালীন আস্তানা স্থানান্তরের আগে সমষ্টিগতভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনুরূপভাবে কোন জাতি-রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের সামিল হওয়ার আগে সমষ্টিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সমষ্টিগত সমাধানের জন্য আবশ্যক রাজনীতিক ইচ্ছা। সমষ্টিগত সমস্যার অস্তিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠে রাজনীতিক ইচ্ছা।

সামাজিক গোষ্ঠী ও সংগঠনসমূহ চেহারা-চরিত্রে যতই জটিল হতে থাকে, রাজনীতিক ক্রিয়াকর্ম বাড়তে থাকে। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকতর স্থায়ী প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা গড়ে উঠে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়মিত ও স্থিরীকৃত ব্যবস্থাই হল সরকার। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের নিয়মিত উপায়-পদ্ধতিই এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রক্রিয়া হিসাবে পরিগণিত হয়।

ব্যাপকতর অর্থে এবং সাধারণভাবে সুশৃঙ্খল নিয়মকানুনের অবস্থাই হল সরকার পদবাচ্য। এ দিক থেকে বিচার করলে সুসংগঠিত সকল সংস্থাতেই সরকারের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে এ রকম সংগঠনের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় সংগঠনসমূহ, বিভিন্ন সামাজিক সংঘ-সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন প্রভৃতি। যাইহোক হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন রাজনীতির অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত সমগ্র সমাজকে স্পর্শ করে। হেগ, হ্যারপ ও ব্রেসলিন বলেছেন: “Our concern, however, is with decisions which are inherently collective, affecting the whole society.”

বিরোধ ও বিরোধ মীমাংসার সূত্র: বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাজনীতি হল একটি ক্রিয়া। এ হল একটি সার্বিক ক্রিয়া। রাজনীতি কোন নৈতিক নির্দেশ নয় (“Politics is an activity, not a moral prescription; it is a universal activity.”)। রাজনীতিক ক্রিয়া সর্বজনীন। সকল রকম সরকারের ক্ষেত্রে রাজনীতিক ক্রিয়া প্রযোজ্য। স্বীকৃত রাজনীতিক কাঠামোসমূহের মধ্যে বহু ও বিভিন্ন কার্যাবলীর সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত কার্যাবলীর মধ্যেই রাজনীতি বর্তমান থাকে। রাজনীতিক কার্যাবলীকেই রাজনীতি বলে। এই রাজনীতি হল একটি সর্বজনীন ধারণা।

সর্বত্রই রাজনীতিক কার্যাবলীর অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায়। অধ্যাপক বলের আরও অভিমত হল রাজনীতির মধ্যে বিরোধের অস্তিত্ব আছে এবং আছে বিরোধ মীমাংসার সূত্র। স্বভাবতই সকল স্তরে এধরনের রাজনীতিক কার্যকলাপের সূত্রপাত সম্ভব (“Political activity is a far more uni versal phenomenon. It involves disagreements, and the reconciliation of those disagree ments and therefore can occur at any level.”)। বিসাঞ্জ ও বিসাঞ্জ ( J. Biesanz and M. Biesanz) ও তাঁদের Introduction to Sociology শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিকে বিরোধ ও বিরোধ মীমাংসার সূত্র হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন।

এই দুই চিন্তাবিদের অভিমত অনুসারে রাজনীতি হল একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে-কোন সংগঠিত গোষ্ঠী তার নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করে। রাজনীতি হল দ্বন্দ্ব বিরোধকে সিদ্ধান্তে রূপান্তরের প্রক্রিয়া। এ রকম বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে যে কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনীতির অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। পরস্পর বিরোধী উদ্দেশ্য ও স্বার্থ থাকলে যে-কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনীতি থাকতে বাধ্য। বিসাঞ্জ ও বিসাঞ্জ বলেছেন: “(Politics is) the translation of conflict into decisions. According to this broad definition, politics is present in any aggregate of human beings with conflicting goals and interests in an office, a college department, a church hierarchy, even a church congregation.”

বিরোধ ও বিরোধ মীমাংসার সূত্র ও সম্ভাবনা বহু ও বিভিন্ন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল একটি রাজনীতিক পরিস্থিতির অর্থাৎ বিরোধ এবং সংশ্লিষ্ট বিরোধের মীমাংসা। অ্যালান বল বলেছেন: “The possibilities are numerous, but the essence of the political situation remains that of conflict and the resolution of that conflict.”

রাজনীতি যে সমস্ত প্রশ্নের বা বিষয়ের অনুসন্ধানের চেষ্টা করে, তা হল রাজনীতিক বিরোধের সূত্র বা উৎস এবং বিভিন্ন পর্যায়ে কিভাবে এই বিরোধের নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

রাজনীতির কাজই হল রাজনীতিক জীবনের বহুমুখী ও বিচিত্র কাজকর্মের উপর অনুসন্ধান চালান। এই সমস্ত বিচিত্র কার্যকলাপের মধ্যেই পাওয়া যায় বিরোধের সঙ্গে আপস করার প্রক্রিয়া। এই কারণে, বলের অভিমত অনুসারে, রাজনীতিক কাজকর্মকে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ বলা যায় না।

এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “It is a permanent feature, and therefore political activity is not an abnormal aspect of human behaviour. It is the process of accomodating the conflict that stems from that diversity.” সকল সমাজেই বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য বর্তমান। এরই মধ্যে সমাজে বিরোধও আছে। এ হল সমাজের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য ও বাস্তব সত্য। আবার এই বিরোধের মীমাংসার প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিকে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি বিশেষ উপায় হিসাবে দেখা হয়। রাজনীতিতে সমঝোতা, মীমাংসা, আপস-আলোচনা প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ উপায়-পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাদ-বিসংবাদের অবসানের কথা বলা হয়। হেউড তাঁর politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Specifically politics is seen as a particular means of resolving conflict that is, by compromise, conciliation and negotiation, rather than through force and naked power. This is what is implied when politics is portrayed as the art of the possible. “এ ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার বা ক্ষমতার নগ্ন প্রয়োগকে অস্বীকার করা হয়।

রাজনীতি কাকে বলে,রাজনীতি মানে কি

এই অর্থে রাজনীতি কথাটির বহুল ব্যবহার প্রাত্যহিক জীবনে পরিলক্ষিত হয়। কোন একটি সমস্যার সমাধানকে যখন রাজনীতিক সমাধান হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তখন বোঝান হয় যে সমাধানের পদ্ধতিটি শান্তিপূর্ণ। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ বিতর্ক বা সালিশী-মধ্যস্থতার সুবাদে সমস্যার সমাধান হয়েছে; শক্তিপ্রয়োগ বা সামরিক পথে সমাধান হয়নি।

রাজনীতির এই ধারণার অন্যতম আধুনিক প্রবক্তা হিসাবে বার্নার্ড ক্রিক (Bernard Crick)- এর কথা বলা হয়। বার্ণার্ড তাঁর In Defence of Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন: “Politics (is) the activity by which differing interests within a given unit of rule are conciliated by giving them a share in power in proportion to their importance to the welfare and the survival of the whole community.”

উপরিউক্ত ধারণা অনুসারে রাজনীতির মূল কথা হল ক্ষমতার ব্যাপক বিসরন। সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিবাদ-বিরোধের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। সমাজবিজ্ঞানী বার্ণার্ড ক্রিক-এর মতানুসারে সামাজিক গোষ্ঠী ও স্বার্থসমূহ ক্ষমতাসংযুক্ত হলে, তাদের মধ্যে মীমাংসা বা বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়; এগুলির বিনাশ সাধন বাঞ্ছনীয় নয়। বার্ণার্ড রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: “solution to the problem of order which chooses conciliation rather than violence and coercion.”।

রাজনীতির এই ধারণা অনুসারে সমাজে বিদ্যমান বিবাদ-বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান-সমঝোতা সম্ভব। তারজন্য ভীতি প্রদর্শন বা হিংসার পথ অবলম্বন অনাবশ্যক। রাজনীতির এই ধারণার প্রবক্তা চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করে যে, সহমতই সমাজের বৈশিষ্ট্য, অনপনেয় বিবাদ-বিসংবাদ নয়। এই মতবাদে বিবাদ-বিরোধ নিরসনের ক্ষেত্রে আপস-আলোচনা ও বিতর্কের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। রাজনীতির এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উদারনীতি ও যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতি অঙ্গীকারের নীতির প্রতিফলন ঘটেছে।

বিরুদ্ধবাদীরা রাজনীতির এই ধারণার বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতানুসারে রাজনীতি সম্পর্কিত বার্ণার্ডের ধারণা পক্ষপাতদুষ্ট। পশ্চিমী বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসমূহে বিদ্যমান রাজনীতির প্রতি বার্ণার্ডের আনুগত্যের অভিব্যক্তি ঘটেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সমাজবিজ্ঞানী রাজনীতিকে নির্বাচনী পছন্দ ও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। রাজনীতি সম্পর্কিত এই ধারণা একদলীয় রাজনীতিক ব্যবস্থায় বা সামরিক শাসনব্যবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়।

রাজনীতির উপরিউক্ত ধারণার সদর্থক দিকটি অনস্বীকার্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে রাজনীতি হল একটি সুসভ্য এবং সুসভ্যকারী একটি শক্তি। সুতরাং একটি সুসভ্য ক্রিয়া হিসাবে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে প্রবণতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

নিজেদের জনসম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনীতিক জীবনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। হিংসা-হানাহানি ও রক্তক্ষয়ের পরিবর্তে রাজনীতি নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। রাজনীতিতে যে বোঝাপড়ার কথা বলা হয়, তা কোন কাল্পনিক বিষয় নয়।

রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় বিবদমান পক্ষসমূহ পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে সমঝোতার সামিল হয়। কোন পক্ষই অনড় অবস্থান গ্রহণ করে না বা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয় না। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “…Crick saw politics as an embattled and often neglected activity. He saw its principal enemy as ‘the desire for certainty at any cost’, and he warned that this is demonstrated in many forms, including the seductive influence of political ideologies, blind faith in democracy, the impact of rabid nationalism, and the promise of science to disclose objective truth.”

ক্ষমতার প্রয়োগ: সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিকে স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। সামাজিক পটভূমি ও সম্পর্কসমূহের ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রয়োগ এবং সামাজিক ক্রিয়া ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এর ফলাফল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই হল সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি। সকল সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই অন্তর্নিহিতভাবে রাজনীতি বর্তমান। এবং এ ক্ষেত্রে রাজনীতির মূল কথা হল ক্ষমতার ব্যবহার।

এইভাবে রাজনীতিক সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। পিতামাতা তাঁদের যুবতী কন্যাকে অধিক রাতে একাকী ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেন; গৃহকর্তা অবাধ্য গৃহভৃত্যকে বিতাড়িত করেন প্রভৃতি কাজকর্মের মধ্যে যেমন রাজনীতি বর্তমান, তেমনি আইনসভায় রাজস্ব আইনের পরিবর্তন সম্পর্কিত কাজকর্মের মধ্যেও রাজনীতি বর্তমান। এদিক থেকে বিচার করলে সমাজজীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই রাজনীতিক উপাদান অন্তর্নিহিত আছে।

সুতরাং রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপের মধ্যে যেমন রাজনীতি আছে; তেমনি আবার নিয়ন্ত্রণ, বাধ্যকরণ ও শাস্তি প্রদানমূলক প্রক্রিয়ার মধ্যেও রাজনীতি আছে। জয়ারাম (N. Jayaram) Introductory Sociology শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “A sociological approach to politics, then implies the analysis of the operation of power in social contexts and relationships and its conse quences for social action and stability.”

সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পর্ক বহু ও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বাধ্য করা ও বাধ্য হওয়া, নির্দেশ প্রদান ও নির্দেশ পালন, অনুরোধ-উপরোধ ও সমঝোতা, বিবাদ-বিসংবাদ ও মীমাংসা প্রভৃতি সামাজিক আচরণের মধ্যে রাজনীতির অভিব্যক্তি ঘটে। হেনজ্‌ ইউলাউ (H. Eulau) তাঁর The Behavioural Persuasion in Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “What makes a man’s behaviour political is that he rules and obeys, persuades and compromises, promises and bargains, coerces and represents, fights and fears.”

রাজনীতি সরকার সম্পর্কিত বিষয়: অনেকে রাজনীতিকে সরকার সম্পর্কিত বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, রাজনীতির আলোচনা হল মূলত সরকার সম্পর্কিত আলোচনা। বৃহত্তর অর্থে বলা যায় যে, রাজনীতি হল কর্তৃত্বের ব্যবহার বা প্রয়োগ। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টন-এর লেখায় রাজনীতির এই ব্যাখ্যা বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে। ইস্টন রাজনীতিকে মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বরাদ্দ (authoritative allocation of values) হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন।

তার অভিমত অনুযায়ী রাজনীতির মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া বর্তমান। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার বৃহত্তর সমাজে সৃষ্ট বিবিধ দাবি-দাওয়া ও চাপের প্রতি সাড়া দেয়। সরকারের এই সাড়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সরকার সুযোগ-সুবিধা, পুরস্কার বা শাস্তি বরাদ্দ করতে পারে। কর্তৃত্বমূলক মূল্য (authoritative values) সমাজে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়।

এবং নাগরিকরা তা বাধ্যতামূলক বলেই বিবেচনা করে। এদিক থেকে বিচার করলে রাজনীতি কর্মনীতি বা কর্মপন্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিধিসম্মত বা কর্তৃত্বমূলক সিদ্ধান্তসমূহের মাধ্যমে জনসম্প্রদায়ের জন্য কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হয়। এই সমস্ত সিদ্ধান্তের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কিত।

উপরিউক্ত অর্থে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিক থেকে বিচার করলে রাজ্যশাসনব্যবস্থা (polity)-র মধ্যেই রাজনীতি সংঘটিত হয়। রাজ্যশাসন প্রণালী হল সামাজিক সংগঠনের এক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সরকারী যন্ত্রের উপরই কেন্দ্রীভূত। সুতরাং রাজনীতি কেবলমাত্র আইনসভা, মন্ত্রিসভা, সরকারী দপ্তরসমূহ প্রভৃতির মধ্যেই সংঘটিত হয়। এবং মুষ্টিমেয় ও বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর মানুষ রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে রাজনীতিবিদ, জনপালন কৃত্যক ও প্রভাববিস্তারকারী (lobbyists)-দের কথা বলা যায়। এর থেকে এই দাঁড়ায় যে, অধিকাংশ মানুষ, অধিকাংশ সামাজিক কার্যকলাপ ও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান রাজনীতির বহির্ভূত।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, ব্যবসায়িক সংস্থাসমূহ, জনসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহ অরাজনীতিক প্রকৃতির। কারণ এই সমস্ত সংস্থা-সংগঠন দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অনুরূপভাবে আবার আধুনিক জীবনধারার উপর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়াদির ও বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও রাজনীতি বহির্ভূত বিষয়। এ প্রসঙ্গে হেউড তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “… there is a growing recognition that the task of managing complex societies is no longer simply carried out by government but involves a wide range of public and private sector bodies. This is reflected in the idea that government is being replaced by governance.”

উপরিউক্ত সংজ্ঞার সুবাদে রাজনীতিকে দলীয় রাজনীতি হিসাবে প্রতিপন্ন করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এদিক থেকে বিচার করলে মতাদর্শগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে সচেতনভাবে পরিচালিত ব্যক্তিবর্গের বা রাজনীতিবিদদের কাজকর্মই হল রাজনীতিক। জনপালনকৃত্যক বা সরকারী কর্মচারীরা নিরপেক্ষভাবে পেশাগত কাজকর্ম করলে তা রাজনীতিক বলে গণ্য হবে না। অনুরূপভাবে বিচারপতিদের কাজকর্মও অরাজনীতিক, যদি তাঁরা নিরপেক্ষভাবে আইন ব্যাখ্যা করেন এবং প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারকার্য সম্পাদন করেন। কিন্তু বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিচারপতিরা পক্ষপাতদুষ্ট হলে বা ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হলে, তা রাজনীতিক বলে অভিযুক্ত হবে।

রাজনীতি ও সরকারের মধ্যে সংযোগ-সম্পর্ক বিষয়ক ধারণার সুবাদে অবহিত হওয়া যায় কেন রাজনীতির সঙ্গে নেতিবাচক ও নিন্দাসূচক বক্তব্য জড়িয়ে ফেলা হয়। জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ধারণা হল যে, রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপের সঙ্গেই রাজনীতি গভীরভাবে সংযুক্ত। জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এই ধারণা নগ্নভাবে বর্তমান যে, রাজনীতিবিদরা হল ক্ষমতালোভী ভণ্ড। জনসেবা ও মতাদর্শের আড়ালে তাঁরা ব্যক্তিগত উচ্চাশাকে লুকিয়ে রাখেন। বর্তমানে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও অসদাচরণকে গণমাধ্যমসমূহ ফলাও করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। তারফলে আধুনিককালে একধরনের রাজনীতি বিরোধী ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অ্যান্ড্রু হেউড্ (Andrew Heywood) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “This rejection of the personal and machinery of conventional political life is rooted in a view of politics as a self-serving, two-faced and unprincipled activity, clearly evident in the use of derogatory phrases such as ‘office politics’ and ‘politicking’.”

রাজনীতি সম্পর্কিত এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের উদারনীতিক ধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে। মনে করা হয় যে, ব্যক্তিবর্গ স্বার্থপর এবং রাজনীতিক ক্ষমতা দুর্নীতিপরায়ণ করে। কারণ রাজনীতিক ক্ষমতা ক্ষমতাশীলদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা সৃষ্টি করে। অন্যান্যদের স্বার্থের বিরুদ্ধেও রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিস্বার্থ সাধনের রাজনীতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটে।

এতদ্‌সত্ত্বেও রাজনীতির সমাপ্তি এবং রাজনীতিবিদদের অবসান অভিপ্রেত নয়। নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর মধ্যে যাতে রাজনীতি সংঘটিত হয়, তা সুনিশ্চিত করা দরকার। তা হলে সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার আটকান যাবে। মনে রাখা দরকার যে মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সমাজে থাকা আবশ্যক। অন্যথায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির ক্রিয়ার ফলে মানবসমাজ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, সমাজে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের সংঘাত সৃষ্টি হবে। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Without some kind of mechanism for allocating authoritative values, society would simply disintegrate into a civil war of each against all, as the early social-contract theorists argued.”

সর্বসাধারণের ব্যাপার হিসাবে রাজনীতি: সরকার সম্পর্কিত বিষয়ের পরিবর্তে জনজীবনের বা সর্বসাধারণের বৃহত্তর বিষয় হিসাবেও রাজনীতিকে প্রতিপন্ন করা হয়। সর্বসাধারণের বিষয় ও ব্যক্তিবিষয়ের মধ্যে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সাবেকি ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ (civil society)-এর মধ্যে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে জনজীবন (public life) ও ব্যক্তিগত জীবন (private life) এর মধ্যে পার্থক্য করা হয়। হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “A… broader conception of politics moves is beyond the narrow realm of government to what is thought of as ‘public life’ or public affairs’ the distinction between the political’ and ‘the nonpolitical’ coincides within the division between an assentially public sphere of life and what can be thought of as private sphere.”

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ সর্বসাধারণের বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। এই সমস্ত বিষয়ের উদাহরণ হিসাবে, আইন-আদালত, সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী প্রভৃতি সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতিকে বোঝায়। জনসম্প্রদায়ের সংগঠিত ও সমষ্টিগত জীবনের জন্য এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং জনসাধারণের টাকায় বা সরকারী খরচে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হয়। এই কারণে এগুলি হল সর্বসাধারণের বিষয়। অপরদিকে পৌর সমাজের বিষয়াদির উদাহরণ হল পরিবার, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, ব্যক্তিগত ব্যবসা, ক্লাব, শ্রমিক সংঘ প্রভৃতি। এই সমস্ত গোষ্ঠী বা সংঘ-সংগঠন ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে এগুলি সম্পর্করহিত। এই কারণে এগুলি হল ব্যক্তিগত বিষয়।

সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত বিষয়ের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজকর্মের মধ্যেই রাজনীতি সীমাবদ্ধ। সরকারী সংস্থাসমূহ যে সমস্ত দায়-দায়িত্ব সম্পাদন করে তাও রাজনীতির বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়।

ব্যক্তিবর্গ জীবনের যে সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিজেরাই সম্পাদন ও নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ সেগুলিকে অ-রাজনীতিক বলে চিহ্নিত করা হয়। ব্যক্তিগত অ-রাজনীতিক কাজকর্ম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে ব্যক্তিগত, সামাজিক, আর্থনীতিক, পারিবারিক, ঘর-গৃহস্থলীর, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

আর একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অপেক্ষাকৃত সুক্ষ্মভাবে সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। এই সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলা হয়। সাধারণত পৌর সমাজকে রাষ্ট্রের থেকে পৃথকভাবে প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু পৌর সমাজের মধ্যেও এমন বহু ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান বর্তমান থাকে, যেগুলি সর্বসাধারণের বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। ব্যাপক অর্থে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত; এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান সর্বসাধারণের মধ্যে সক্রিয় এবং এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার স্বীকৃত।

এই দিক থেকে বলা হয় যে, কর্মক্ষেত্রেও এক ধরনের রাজনীতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির ধারণার পরিধিকে অধিকতর প্রসারিত করা হয়। এবং আর্থনীতিক বিষয়টিকে ব্যক্তিগত বিষয়ের পরিবর্তে সমষ্টিগত বিষয় হিসাবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী, ক্লাব, ব্যবসা, শ্রমিকসংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে সর্বসাধারণের বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এতদ্‌সত্ত্বেও এ হল রাজনীতির এক সীমাবদ্ধ ধারণা। এই প্রেক্ষিত অনুযায়ী ব্যক্তিগত বিষয়াদিকে বা প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাজনীতি স্পর্শ করবে না, বা করা উচিত নয়। বিশেষতঃ নারীবাদী চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতি, ঘরের দুয়ার অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থসমূহ, গার্হস্থ্য জীবন ও পরিবারের মধ্যে রাজনীতির কোন জায়গা থাকবে না।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয় যে, রাজনীতিকরা সাধারণত তাঁদের পেশাগত বা রাজনীতিক আচরণ এবং পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপাদনের উপর জোর দেন। তারা ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধুকে বা সহকর্মীকে প্রতারণা করাটাকে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকের ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। কারণ হিসাবে বলা হয় যে, এই প্রতারণা কর্মের কোন রকম রাজনীতিক গুরুত্ব বা তাৎপর্য নেই। দাবি করা হয় যে, এই সমস্ত আচরণ বা বিষয় নিতান্তই ব্যক্তিগত, সর্বসাধারণের জীবনকে এসব বিষয় স্পর্শ করে না।

রাজনীতিকে সর্বসাধারণ সম্পর্কিত কার্যকলাপ হিসাবে প্রতিপন্ন করার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রাচীনকালে গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলের আমলে রাজনীতিকে মহৎ-মহান ও এলিট কাজকর্ম হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমষ্টিগত প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির উপর মহত্ত্ব আরোপ করা হয়েছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, মানবিক কার্যকলাপের মধ্যে রাজনীতি হল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ রাজনীতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে স্বাধীন ও সমানাধিকার সম্পন্ন নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রাজনীতির মাধ্যমে ব্যক্তি-মানুষের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে, এবং প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও অনন্যসাধারণ প্রকৃতি প্রকাশিত হয়।

রুশো ও জন স্টুয়ার্ট মিলের মত রাষ্ট্রদার্শনিকরা ব্যক্তি-মানুষের রাজনীতিক অংশগ্রহণকে প্রশংসনীয় বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। রুশোর অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক জীবনে সকল নাগরিকের সক্রিয়, সরাসরি ও অবিরাম অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনে বাধ্য করা যায়। রুশো একেই ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ (general will) হিসাবে অভিহিত করেছেন। মিলের মতানুসারে সর্বসাধারণের বিষয়াদির সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্ক শিক্ষামূলক। কারণ এর মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত, নৈতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ সম্পাদিত হয়।

আবার বিপরীতক্রমে সর্বসাধারণের বিষয় হিসাবে রাজনীতির বিরূপ সমালোচনাও করা হয়েছে। এদিক থেকে রাজনীতিকে অনভিপ্রেত বিষয় হিসাবে দেখা হয়েছে। এদিক থেকে বলা হয় যে, রাজনীতি সমাজের নৈতিক স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষভাবে ক্ষতিকর। কারণ মানুষের স্বাধীন ও স্ববিবেচনামূলক কার্যকলাপের পথে রাজনীতি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

উদারনীতিক তাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রের পরিবর্তে নাগরিক সমাজ (civil society) বা পৌর সমাজের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। কারণ হিসাবে তারা বলেন যে, ব্যক্তিগত জীবনে পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্র বর্তমান থাকে। এই কারণে রাজনীতিক কার্যকলাপের পরিধিকে যথাসম্ভব সংকুচিত করার কথা বলা হয়। বলা হয় যে, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধূলা ও পরিবার-জীবনের মত ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্মের থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখা দরকার।

ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়: ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডাল-এর অভিমত অনুসারে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব বা শাসন হল রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মূল কথা। হ্যারল্ড লাসওয়েল (Harold Lasswell)-এর মতানুসারে ক্ষমতার সংগঠন ও অংশীদার সম্পর্কিত আলোচনাই হল রাজনীতি (…..the study of the shaping and sharing of power”)।

ক্ষমতা রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিতর্কের অবকাশ সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতির উদ্দেশ্যই হল ক্ষমতার অধিকার লাভ বা ক্ষমতা প্রয়োগ। এ হল রাজনীতির আশু উদ্দেশ্য। তবে রাজনীতির অন্য কোন চূড়ান্ত উদ্দেশ্য থাকতে পারে। চার্লস স্নেইচার (Charles P. Schleicher) তাঁর Interna tional Relations শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “It is sometimes contended that whatever may be the ultimate end of politics power is the immediate end.” রাজনীতিক কার্যাবলীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ আন্দোলন প্রভৃতি থাকে। এবং এই সমস্ত রাজনীতিক কার্যাবলীর মধ্যে ক্ষমতার ব্যবহার অনস্বীকার্য। এই কারণে অনেকে রাজনীতিকে ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। কর্তৃত্বমূলক বা সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও দ্বন্দ্ব-বিবাদ বর্তমান থাকে। স্বভাবতই এই সমস্ত কার্যকলাপও রাজনীতির অঙ্গীভূত।

ক্ষমতা হিসাবে রাজনীতির সংজ্ঞার্থ সর্বাধিক ব্যাপক ও র‍্যাডিকাল। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাজনীতি কেবলমাত্র রাষ্ট্র, সরকার বা সর্বসাধারণের বিষয়াদির মত সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। ক্ষমতার বিচারে রাজনীতি সকল সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে এবং মানবজাতির অস্তিত্বের সকল ক্ষেত্রে সংযুক্ত। অড্রিয়ান লেফটউইচ (Adrian Leftwich) তাঁর What is Politics? The Activity and Its Study শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার বিচারে রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন।

এই সমাজবিজ্ঞানীর ধারণা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক-অ-আনুষ্ঠানিক এবং সর্বসাধারণ ও ব্যক্তিগত নির্বিশেষে সকল সমষ্টিগত সামাজিক কার্যকলাপের মূলে রাজনীতি বর্তমান; সকল মানবগোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও সমাজব্যবস্থার কেন্দ্রে রাজনীতি বর্তমান। লেফটউইচকে অনুসরণ করে হেউড তাঁর politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…politics is at the heart of all collective social activity, formal and informal, public and private, in all human groups, institutions and societies’. In this sense, politics takes place at every level of social interaction,………. .” এ দিক থেকে বিচার করলে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার সকল পর্যায়ে রাজনীতিক ক্রিয়াকর্ম সংঘটিত হয়। পরিবার-পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবের ছোট ছোট গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি আবার বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রাজনীতি আছে।

হ্যারল্ড লাসওয়েল (Harold Lasswell) তাঁর Politics: Who Gets What, When, How? শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। ব্যাপকতর অর্থে সামাজিক অস্তিত্বের ধারায় উৎপাদন, বণ্টন ও সম্পদ-সামগ্রীর ব্যবহারের ব্যাপারে রাজনীতির অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। রাজনীতি হল মূলত ক্ষমতা, এ হল যে কোন উপায়ে অভিপ্রেত ফল লাভের সামর্থ্য। এদিক থেকে অপ্রতুলতার অস্তিত্ব রাজনীতির অন্যতম মৌলিক উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। মানুষের প্রয়োজন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অপরিসীম। কিন্তু প্রয়োজন পূরণ বা আশা-আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির সহায়ক সম্পদ-সামগ্রী সবসময়ই সীমাবদ্ধ। এই অপ্রতুল সম্পদ-সামগ্রীর জন্য বিবাদ-বিসংবাদ রাজনীতি হিসাবে পরিগণিত হয়। এবং ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই বিবাদ-বিসংবাদ ঘটতে থাকে।

ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির এ ধরনের ব্যাখ্যাকারকদের মধ্যে মার্কসবাদীরা আছেন এবং আধুনিক নারীবাদীরা আছেন।

মার্কসবাদীদের দুটি অর্থে রাজনীতি কথাটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। মার্কস সার্বিক ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ (Communist Manifesto)-তে মার্কস রাজনীতিক ক্ষমতাকে সংগঠিত ক্ষমতা হিসাবে দেখিয়েছেন। একটি শ্রেণীর এই সংগঠিত ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়, অন্য শ্রেণীর উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম করার জন্য।

মার্কস রাজনীতিকে উপরিকাঠামো (superstructure)-র অংশ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। সমাজ-জীবনের মূল ভিত্তি হল অর্থনীতি এবং আইন-আদালত সংস্কৃতির মত রাজনীতি হল উপরিকাঠামোর অংশবিশেষ। মার্কস অর্থনীতিক ভিত্তি এবং আইনসঙ্গত ও রাজনীতিক উপরিকাঠামোকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে দেখেননি। উপরিকাঠামোর সৃষ্টি হয় আর্থনীতিক ভিত্তি থেকে এবং উপরিকাঠামোতে আর্থনীতিক ভিত্তির প্রতিফলন ঘটে। রাজনীতিক ক্ষমতার মূল সমাজের শ্রেণীব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতি হল অর্থনীতির অতীব ঘনীভূত রূপ (“politics is the most concentrated form of economics”)।

আধুনিককালের নারীবাদীরা রাজনীতিক ধারণার ব্যাপারে অত্যধিক আগ্রহ দেখান। রাজনীতিক জীবনের আধুনিক নারীবাদীদের এই পরিবর্তিত অবস্থানের একটি পটভূমি বর্তমান। রাজনীতি সম্পর্কিত সাবেকি ধারণা অনুযায়ী মহিলাদের সতর্কতার সঙ্গে রাজনীতিক জীবনের এলাকার বাইরে রাখা হয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ঐতিহ্যগত রাজনীতিতে পুরুষদের প্রাধান্য চিরকালের। শুধু মাত্র রাজনীতি নয়, জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুরুষদের প্রাধান্য স্বীকৃত। সনাতন ধারা অনুযায়ী পরিবার ও ঘর-গৃহস্থলীর মত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের মধ্যেই মহিলাদের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

মৌলিক সংস্কারপন্থী নারীবাদীরা সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এই অবস্থার পরিবর্তনের পক্ষপাতী। তারা মানুষের জীবনধারার বিষয়াদির ‘সর্বসাধারণের ও ব্যক্তিগত’ এ ধরনের বিভাজনের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী ব্যক্তিগত বিষয়াদিও রাজনীতিক। সংস্কারপন্থী নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, পারিবারিক, গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়াদিও গভীরভাবে রাজনীতিক। তাঁরা এও মনে করেন যে, অন্যান্য রাজনীতিক সংগ্রামের মূলে আছে এই সমস্ত পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়। রাজনীতি সম্পর্কিত নারীবাদীদের এই ধারণা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাতে মিল্লেৎ (Kate Millett) তাঁর Se*x*ual Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতির ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন যে, রাজনীতি হল ক্ষমতা কাঠামোগত সেই সমস্ত সম্পর্ক ও ব্যবস্থা যার দ্বারা ব্যক্তিবর্গের একটি গোষ্ঠী আর একটি গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (“power-structured relationships, arrangements whereby one group of persons is controlled by another.”)।

বস্তুত নারীবাদীরা রাজনীতির ধারণা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনের রাজনীতির উপর জোর দেন। এঁদের অভিমত অনুযায়ী সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে বা মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্কসমূহ যেমন রাজনীতিক, অনুরূপভাবে পরিবারের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এবং পিতামাতা ও সন্তানসমূহের মধ্যে সম্পর্কও সমভাবে রাজনীতিক প্রকৃতির।

রাজনীতি সম্পর্কিত নারীবাদী ও মার্কসবাদীদের ধারণা বহুলাংশে নেতিবাচক। কারণ রাজনীতিকে সাধারণভাবে দমন পীড়নমূলক ও বশীকরণমূলক বিষয় হিসাবে দেখান হয়েছে। সংস্কারপন্থী নারীবাদীদের অভিমত অনুযায়ী সমাজ হল পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ-শাসিত। পুরুষ-শাসিত এই সমাজে সুপরিকল্পিতভাবে মহিলাদের পুরুষ-শক্তির বশীভূত ও নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়। মার্কসবাদীদের সাবেকি যুক্তি হল যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বুর্জোয়াদের দ্বারা সর্বহারাদের শোষণ হল রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।

রাজনীতি সম্পর্কিত নারীবাদী ও মার্কসবাদীদের এই নেতিবাচক ধারণার ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, রাজনীতিক উপায়-পদ্ধতির মাধ্যমে অন্যায়-অবিচার এবং দমন-পীড়ন-বশীকরণের বিরোধিতা করা যায়। সংস্কারপন্থী নারীবাদীদের মতানুসারে লিঙ্গগত বিপ্লবের মাধ্যমে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন।

মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী সর্বহারাদের বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী শোষণের অবসান ঘটবে। সমাজবিজ্ঞানী হেউড তার Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “…when politics is portrayed as power and domination it need not be seen as an inevitable feature of social existence. Feminist look to an end of ‘se*xua*l politics’ achieved through the construction of a nons*exist society, in which people will be valued according to personal worth rather than on the basis of gender. Marxists believe that ‘class politics’ will end with the establishment of a classless communist society.”

রাষ্ট্র ও রাজনীতি: রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। অনেকের অভিমত অনুসারে আলোচ্য দুটি শব্দ যমজ সম্পর্কে আবদ্ধ। স্বভাবতই রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কেও বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

আধুনিককালের রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাবাদী আলোচনার ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতি হল সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিশেষ সুযোগ সুবিধার বরাদ্দ এবং ক্ষমতার জন্য সংগঠিত গোষ্ঠীসমূহের সংগ্রাম। কোন বিশেষ মতাদর্শের উপলব্ধির সঙ্গে বাস্তব রাজনীতির তেমন কোন সম্পর্ক নেই। নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির কাঠামোর মধ্যে বিশেষ সুযোগ সুবিধা আদায়ের প্রক্রিয়া হল রাজনীতি। সাম্প্রতিককালের সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয় রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর পরিধির মধ্যে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে সকল ধরনের সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ ছিল কিনা। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে রাষ্ট্র পূর্ব অবস্থায় রাজনীতিক কার্যকলাপ ছিল কিনা। কারণ রাষ্ট্র কোন শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্রহীন সমাজজীবনের আলোচনাও সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনায় আছে।

আবার আধুনিককালের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও সকল সমাজব্যবস্থায় বর্তমান ছিল না। নৃতত্ত্ববিদরা কিন্তু রাজনীতিক ব্যবস্থাকে একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী। এঁদের মতানুসারে উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রহীন (Acephalous) সমাজব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই রাজনীতিক সমাজব্যবস্থা বর্তমান ছিল। তবে রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতিগত রকমফের অনস্বীকার্য। মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে কোন সমাজব্যবস্থায় কোন না কোন রকমের একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ পরিলক্ষিত হয়।

নির্দিষ্ট একটি এলাকায় এই কর্তৃপক্ষের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এলাকার অধিবাসীদের উপর এই কর্তৃপক্ষ বলপ্রয়োগের ক্ষমতার অধিকার ভোগ করে। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সকল ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা সরাসরি প্রয়োগ করে না। সামরিক বাহিনী, আমলা বাহিনী বা ধর্মীয় কর্তাব্যক্তিদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রযুক্ত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে এবং হয়েছেও। ঈশ্বরীয় বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগত, নির্বাচনমূলক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের শাসক বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। অধ্যাপক জয়ারাম (N. Joyaram) Introductory Sociology শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Political control… is ultimately achieved by the use of, or the possibility of the use of, force, with the control of the instruments of such coercion in the hands of the occupants of specialised and differentiated political statuses.”

তো আজকে আমরা দেখলাম যে রাজনীতি কাকে বলে এবং আরো অনেক বিস্তারিত বিষয় । যদি পোস্ট ভালো লাগে তাহলে অব্যশয়, আমাদের বাকি পোস্ট গুলো ভিসিট করতে ভুলবেন না!

রাজনীতি কাকে বলে,রাজনীতি মানে কি,

Leave a Comment